কলেজে রাতুল খুব রেগুলার , ভদ্র স্টুডেন্ট তা না, তাই বলে একেবারে ফেলনা ও না। প্র্যাক্টিক্যাল
মেসের পথ মাড়াতেই মনটা কেমন যেন আনমনে হয়ে যায় রাতুলের। বাড়িতে যাওয়া হয়না অনেকদিন, মাকেও দেখা হয়না। মা ছাড়া আর কেউ নেই এই ছেলেটার। এই শহরে টিকে থাকার তাগিদে গ্রাম তাকে ছাড়তেই হত। ছেলের ভালোর কথা ভেবে মা কিছু জমি-জিরাত বিক্রি করে তাকে পড়ালেখা করতে ঢাকায় পাঠিয়েছে। এখানে অবশ্য তার খরচ সে নিজেই জোগাড় করে নিতে পারে। এমনকি ভাগ্য ভাল হলে মাঝে মধ্যে মাকে কিছু টাকাও পাঠিয়ে দিতে পারে। কবে যে এই অবস্থার একটা চিরস্থায়ী পরিবর্তন হবে এমনটা ভাবতে ভাবতে ওর চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসে। হঠাৎ এক জোরালো ধাক্কায় মনে হয় নিযুত নিযুত মাইল দূরে ছিটকে পড়ে। কিছু না দেখেই ভয়ে হাত পা সিটিয়ে যায় রাতুলের। “ কোনো জ্বীনের সাথে ধাক্কা খাইনি তো ? মা সবসময় বলে ভরদুপুরে নাকি জ্বীনরা ঘোরাঘুরি করে। খাইসে আমারে ! ” ভাবতে ভাবতে গায়ের ধূলো ঝাড়তে ঝাড়তে উঠে দাঁড়ায়। এ কি, এটা দেখি একটা মেয়েমানুষ। বিরক্তির ভাব আরো এক কাঁটা পেরিয়ে যায়। মেয়েটাও ছিটকে পড়ে সামান্য দূরে। মেয়েটার হাতের ডিজাইন করা ব্যাগটা একপাশে নেতিয়ে পড়ে আছে। দুএকটা চিমটা, একটা কাঁচি, ছোট সাইজের দুটা ছোরা টাইপের কি যেন বাইরে ছড়িয়ে পড়েছে। মেয়েটা নির্ঘাত বায়োলজির স্টুডেন্ট। বায়োলজি রাতুলের দুই চোখের বিষ।
“ কি ম্যাডাম, দেখে চলতে পারেন না? রাস্তাটা কি আপনার আব্বাজান অর্ডার দিয়ে বানিয়েছে ? ” রাতুলের মুখ দিয়ে তিতা করলার মত তিতা কথা বের হতে শুরু করে।
মেয়েটা কিছুক্ষন এক নজরে তাকিয়ে থাকে। চোখদুটো আচমকা বিস্ফোরিত হয়ে ওঠে। রাতুল এবার চিন্তা করে, কিছু কি বেশি ভুল বলে ফেললো নাকি অতিরিক্ত হয়ে গেলো ? মেয়েটার তো জানার কথা না, রাতুলের এখন মন কতটা খারাপ। মেয়েটা কিছুক্ষন এক নজরে তাকিয়ে থাকে। তারপর চোখ ফিরিয়ে নিয়ে পড়ে যাওয়া জিনিসগুলো একে একে কুড়িয়ে নেয়, কোনো কথা শুনায়না রাতুলকে। কি আশ্চর্য !
রাতুল ভাবে, মেয়েদের সম্পর্কে নানা কথা শুনেছি, কিন্তু এই মেয়ে দেখি তার উল্টা। এতক্ষনে অন্য কোনো মেয়ে হলে মুখে ৫ আঙ্গুলের দাগ বসিয়ে দিত , ভাবতে ভাবতে রাতুল আনমনে গালে হাত বুলায়। রাতুলকে আরেকটু বেশি অবাক করে দিয়ে মেয়েটা গটগট করে হেঁটে চলে যায়। এহ, খুব তাড়ায় আছে ! “ ভারী আচ্ছা মেয়ে তো ! ” আওড়াতে আওড়াতে রাতুল ও মেসের পথ ধরে।
“ দোস্ত স্যরি, কাল গার্লফ্রেন্ডের সাথে ডেটিং ছিলো। তাই তোর নোটসগুলো ফেরত দিতে আসতে পারিনি। আমাদের জুনিয়র ব্যাচের অহনা, চিনিস না? ওর সাথেই শেষমেশ ঝুলে পড়লাম। ”
কথাগুলো বলে ফিকফিক করে হাসতে থাকে সায়েম। রাতুল চোখে একরাশ বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে থাকে সায়েমের মুখের দিকে। ছেলেটার এই লিক্যুইড স্বভাব ওর মোটেও পছন্দ না। কিসের রিলেশন করে, কিসেরই বা প্রেম করে, হাজার বছর সাধনা করলেও মনে হয় এর কোনো জবাব রাতুল পাবেনা। সায়েমের এই একটা বদ অভ্যাস ছাড়া আর কিছুই নেই রাগ করার মত। অবশ্য, ওর এই পরিবর্তনের পেছনের কারণটা রাতুলের ভালভাবে জানা আছে। সেই এক লুতুপুতু কাহিনী, মেয়ে সুযোগ বুঝে অন্য ছেলের সাথে চলে গেছে, নিজের সুখী ভবিষ্যতের কথা ভেবে। আর সায়েমের মত ছ্যাকা খেয়ে ব্যাকা হয়ে যাওয়া ছেলেরাও এক্সকিউজ খুঁজে পায় মেয়েদের সাথে টাইপিক্যাল প্রেমের রিলেশন করতে। রাতুল ভাবে, সায়েমের মত ধনী বাবার একমাত্র সন্তান যেখানে পাত্তা পেলোনা, সেখানে ওর নিজের ভাগ্য যে খুব বেশি সুপ্রসন্ন না, এটা ভাবাটা দোষনীয় কিছু নয়। রাতুলের আছেই বা কি? আর সায়েম ? ব্যক্তিগতভাবে, ও একটা লোভনীয় ক্যারেক্টার। গান গায় দারুন, দুর্দান্ত ভালো খেলোয়াড়, ভাল লেখালেখি ও করে। মনে মনে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে রাতুল। নাহ, ওকে দিয়ে কিচ্ছু হবেনা।
“ ওই দেখ বেটা, অহনা যাচ্ছে। আর হাড় হাভাতেগুলো কিভাবে পেঁচার মত চোখ করে তাকিয়ে আছে দেখ ”
সায়েম রাতুলের কানের পাশে বিড়বিড় করে বলে আর ফিকফিক করে হাসে। অহনা কেনো, কোনো মেয়ে এই মুহূর্তে ডান্স দিলেও তার তাকানোর ইচ্ছা হবেনা, তাও বন্ধুর কথায় ফিরে তাকায়। হুম, সাদা বিলাই এটাকেই বলে হয়তো। শালার রুচিতে ঘুনপোকা ধরেছে নিশ্চিত। কথাগুলো মনে মনেই বলে, মুখে আর আনেনা। অহনার পাশে একটা মেয়েকে একপাশ ফিরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রাতুল। কেমন যেন পরিচিত পরিচিত লাগছে, মুখটাই দেখা যাচ্ছেনা ঠিকমত। কে এটা ? অহ ইয়েস, এটা তো কালকের সেই মেয়েটা। এটা কি অহনার বান্ধবী? হবে হয়তো। চোখের নিমিষে দুইজন অদৃশ্য হয়ে যায়। হুম, ক্লাশ শুরু হবে কিছুক্ষণের মধ্যেই। চশমাটা একবার ফুঁ দিয়ে মুছে নিয়ে ক্লাশের পথে পা বাড়ায় রাতুল আর সায়েম।
মেসের ছোট্ট রুমটায় এসেই বিছানায় গা এলিয়ে দেয় রাতুল। পড়ালেখার চাপে আর ব্যস্ততায় দিনগুলো কিভাবে কেটে যায় বুঝতেই পারেনা সে। বাঁচার জন্য, পড়ালেখার জন্য এই প্রানান্ত চেষ্টা তার চোখে জল আনে। আজ এই অবস্থাতেও হয়তো সে থাকতো না, যদি সায়েম ওকে সাহায্য না করতো। আর্থিকভাবে, মেন্টাল সাপোর্ট দিয়ে ছেলেটা সবসময় ওর স্বপ্ন পূরণে সাহায্য করেছে। এমনকি, হয়তো টাকার অভাবে মায়ের চিকিৎসা হতোনা যদি না সায়েম সব বন্ধু-বান্ধব এক করে টাকা জোগাড় করে তাকে সাহায্য না করতো। মা ছাড়া তো রাতুলের আর কেউ নেই...মাঝে মাঝে এসব ভাবলে ছেলেটার উপর আর রাগ করা যায়না। বরং তাকে নিয়ে মনের মধ্যে বিরক্তির উদ্রেক হয় বলে নিজের মনকেই ধিক্কার দেয় রাতুল। ছেলেটা আর যাই করুক, কোনো খারাপ কাজে অন্তত জড়িয়ে নেই, কারো ক্ষতি করছেনা, এইসব ভেবে নিজের মনকে নিজেই প্রবোধ দেয়। ফোনের বিরক্তিকর আওয়াজে ভাবনায় ছেদ পড়ে। আহ, সায়েমের ফোন, বেটা বাঁচবি অনেক দিন, মনে মনে বলতে বলতে রাতুল ফোন ধরে।
“ ফোন দিতে দিতে চার্জ গেলো, কোথায় ছিলি? এতক্ষণ ধরলিনা কেন? জরুরী কাজ না থাকলে কি তোকে ফোন দেই এতবার? ”
একগাদা কথা এক নিঃশ্বাসে বলে একটু দম নেয় সায়েম। রাতুলের এবার একটু টেনশন লাগে, কিন্তু ভাব ভঙ্গিতে প্রকাশ করেনা।
“ কী ব্যাপার, এতো টেনশন কিসের? সামথিং সিরিয়াস? ”
“আব্বু আম্মু নানুর বাড়িতে গেছে। বাসায় আয়, বলব।”
সংক্ষেপে কথা সেরে রেখে দেয় সায়েম। ওপাশে রিংগারে বিপ বিপ টোন শুনে রাতুল ও ছুট লাগায়।
“ এত বড় একটা ঘটনা, কই তুই আগে তো আমাকে কোনদিন বলিস নি ! ” রাতুলের চোখে মুখে নিখাদ বিস্ময়।
“ আমি নিজেও জানতাম না এরকম একটা কিছু হবে। জানলে কোনদিনও ঐ মেয়ের দিকে হাত বাড়াতাম না । এখন নিজের খাল কেটে নিজেই কুমির আনলাম। এই কুমির এখন আমার ঘাড় মটকে খাবে। ” সায়েমের কণ্ঠে কুমিরের পেটে যাওয়ার আগ মুহূর্তের আকুতি শুনে মেজাজ আরো খিচড়ে যায় রাতুলের।
“ যে মেয়েটা ৩ বছর আগে মারা গেছে, সে তাহলে অহনার বড় বোন। কিন্তু এখানে তো তোর কোনো দোষ নেই। মেয়েটা প্রেগন্যান্ট হয়েছিল তার বয়ফ্রেন্ডের কারনে। আর ওই চালবাজ ছেলে সুযোগ বুঝে কেটে পড়েছে। মেয়েটাও লোকলজ্জ্বার ভয়ে ছাদ থেকে পড়ে সুইসাইড করে। এখানে তোর দোষটা কোথায়? ”
রাতুলের চোখে বিরক্তি আর বিরশভঙ্গি ছাড়া সায়েম আজ অব্দি অন্য কোন প্রতিক্রিয়া দেখেনি। তাই আজ ওর চোখজোড়ায় নির্ভেজাল কৌতূহল দেখে সায়েম স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে ফিকফিক করে হেসে দেয়। রাতুল আরো এক দফা অবাক হয়। এমন মুহূর্তে কেউ হাসতে পারে? আজ আর রাতুলের বিরক্ত লাগেনা, বরং অবাক লাগে। ওকে আরো বেশি অবাক করে দিয়ে সায়েম বলতে শুরু করে,
“দোষটা আমার পুরোপুরি না হলেও কিছুটা অবশ্যই আমার। আমিই ওই মেয়ের সাথে মুহিত সেজে কথা বলতাম সবসময়। মুহিতের এত সময় কোথায় ছিলো এত্ত এত্ত গার্লফ্রেন্ড ছেড়ে একজনকে নিয়ে পড়ে থাকার? কথা বার্তা যা বলার, তা আমি বলেছি। বিলিভ মি, আমি ফ্রেন্ডের মত বিহেভ করেছি সবসময়। বাট এরপর দেখা হবার পর দুইজন কি করেছে এসব আর আমি জানিনা। এমনকি হারামীটা আমার নামটাই ব্যবহার করে মেয়েটার সাথে কথা বলেছিলো। নাম আমার, এড্রেস আমার, সব দিক থেকে আমিই ফেঁসে গেলাম। যখন ঘটনা কিছুটা জানাজানি হল, বাবা পুলিশকে টাকা খাইয়ে চুপচাপ রেখেছে। এই যাত্রা বেঁচে গেছি শুধু একটা কারনে, বাবা আমাকে বিশ্বাস করেন বলে। নইলে আর দেখতে হতনা। এতদিনে গলায় ফাঁসির দড়ি ঝুলতো।”
কথাগুলো বলে শুন্য দৃষ্টিতে জানালার দিকে চেয়ে থাকে সায়েম। সেই চোখে প্রথমবারের মত রাতুল দেখলো এক রাশ হতাশা।
সারারাত বিছানায় গড়াগড়ি দেয় রাতুল, কিন্তু ঘুম আসেনা। বন্ধুকে এমন একটা দোটানার মাঝে দেখেও কিছু না করা তার কাছে কাপুরুষতা ছাড়া আর কিছু না। তার উপর তার মাকে বাঁচানোর ঋণ – এটা তো জীবন দিয়েও শোধ হবার নয়। আচ্ছা, আমাকে তো সায়েম বলল না, অহনা ঐ মেয়েটার বোন এটা ও কিভাবে জানলো? এই কথাটা এতক্ষন কেনো মাথায় আসেনি? শিট ! মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে তাকালো রাতুল। ১০:৩০ টা। খুব বেশি রাত হয়েছে কি? এখন সায়েমের বাসায় যাওয়াই যায়। আংকেল আন্টিও নেই। ব্যাপারটা নিয়ে খোলামেলা আলাপ করা যাবে। ইয়েস, এক্ষনি যাওয়া উচিত।
এত রাতে ডাকাত-পুলিশের ভয় উপেক্ষা করে রাতুল ছুটে এসেছে, ওদিকে সায়েমের ফোনটাও সুইচড অফ বলছে। কলাপ্সেবল গেটও বন্ধ। সেটা খুলতে হলে সায়েমের সাহায্য লাগবে। রীতিমত ঘামতে শুরু করে রাতুল। নাহ , এই মুহূর্তে ভয় পেয়ে কোন কাজ হবেনা। ভেবে চিন্তে সায়েমের বাসায় ঢোকার রাস্তা বের করবে কিভাবে ভাবতে লাগলো। এত বড় কলাপ্সেবল গেটটা ডিঙ্গিয়ে যাওয়াতো সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। একবার না পারিলে দেখো শতবার, ভাবতে ভাবতে পেশীর উপর সব বল দিয়ে, শার্টের কয়েক জায়গা ছিঁড়ে, হাত পায়ে ব্যথা পেয়ে, অনেক কষ্টে গেটটার ওপাশে বোঁটা ছেঁড়া কাঁঠালের মত ধুপ করে পড়ে যায় রাতুল। ভাগ্যিস, গেটটা মেইন বিল্ডিং থেকে বেশ খানিকটা দূরে ছিলো। দুদ্দাড় দৌড় দিয়ে ও সোজা তিন তলায় উঠে গেলো। দরজায় কয়েকবার আঘাত করতেই ওপাশ থেকে যেন কেউ আলতো করে দরজাটা খুলে দিলো। শালা কি রাত দুপুরে মেয়েমানুষ ঘরে ঢুকিয়ে বসে আছে নাকি? ধুর, এসব কি ভাবছে ! ছিহ, না জেনে বুঝে এমন চিন্তা আনাও ঠিক না। রাতুল নিজের কাছে নিজেই আত্মসমর্পণ করে।
শোবার ঘরটা ফাঁকা, ডাইনিং ও। ছেলেটা গেলো কোথায়? বাথরুমগুলোও চেক করলো রাতুল। না, কোথাও নেই। ওর তো রাতে বাইরে যাওয়ার ও অভ্যাস নেই। সিগারেট খাবার ও অভ্যাস নেই যে রাত বিরাতে সিগারেটের তৃষ্ণা পেলে বাইরে ছুটে যাবে। অথচ স্পষ্ট বুঝতে পেরেছিল রাতুল, কেউ যেনো দরজাটা খুলে দিয়েছে। অবাক কান্ড। একবার কিচেনটা দেখে আসবে ভেবে কিচেনের দিকে পা বাড়ায়। অন্ধকারে যেন পিচ্ছিল কিছুর উপর আছাড় খেয়ে পড়ে।
“ও মা, কোমরটা শেষ একেবারে।” রাতুল কঁকিয়ে ওঠে।
বিরক্তির আর সীমা থাকেনা রাতুলের। এমন অন্ধকার করে রাখার কি দরকার ছিল। পকেটে লাইটারটাও খুঁজে পায়না রাতুল। অগ্যতা রুমের সুইচবোরড খুঁজতে থাকে ও। লাইটটা খুঁজে বের করতেও খানিকটা সময় লাগে। কেমন যেন একটা নোনতা নোনতা গন্ধ ওকে ঘিরে ফেলে। ডিজগাস্টিং ! লাইট জ্বালাতেই হতভম্ব হয়ে যায় রাতুল। ওর সারা শরীরে রক্ত। এগুলো কোথা থেকে আসলো? ঘটনা বুঝতে ওর কয়েক সেকেন্ড সময় লাগে। তারপর কিচেনের দিকে দৌড়ে যায় তৎক্ষণাৎ । হয়তো একটা অঘটন ওখানেই ঘটে গেছে। না, কিচেনে রক্ত ছাড়া আর কিছু নেই। ওর সারা শরীরে বিদ্যুতচমকের মত পুরো ব্যাপারটা মাথায় চলে আসে। সায়েমকে তাহলে বিল্ডিঙের পেছন দিকটায় ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে হয়তো। কারন, সামনের দিকটা ও পেরিয়েই এসেছে, কিছু নজরে পড়েনি। এখন কি ছাদে যেয়ে একবার দেখে আসবে? না না, সময়ের অপচয় করা যাবেনা এখন। বরং ঠান্ডা মাথায় সায়েমের মোবাইল, ল্যাপটপ আর কোনো ডায়েরী আছে কিনা খুঁজে দেখতে হবে। রাতুল সায়েমের রুমটা তন্ন তন্ন করে খোঁজে। উহু, কোনো প্রমান রেখে যায়নি খুনী। কিন্তু কোথাও না কোথাও তো অন্তত একটা ক্লু থাকার কথা। রাতুল খুব ভালোভাবে বুঝতে পারে এই কাজটা কার। হঠাত মেজাজটা খিচড়ে যায়। বন্ধুর এমন নির্মম পরিনতি সে কখনোই প্রত্যাশা করেনি। সায়েমটা এভাবে চলে যাবে রাতুল ভুলেও ভাবতে পারেনি। বন্ধুর ঋণ এখনো শোধ করা বাকি তার !
এত রাতে রাস্তায় ট্যাক্সি, অটো কিছুই নেই। একটা রিক্সা পেয়ে যায় , তাও আবার দুইগুন বেশি ভাড়া চেয়ে বসে। এই মুহূর্তে ভাড়া নিয়ে দামদর করার সময় মোটেও নেই রাতুলের হাতে। তার উপর শার্ট ভর্তি রক্ত। অন্ধকার বলে কারো নজরে পড়েনি অবশ্য এখন পর্যন্ত। কিন্তু কারো নজরে পড়ে গেলে আর দেখতে হবেনা। রিক্সায় বসে পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে পকেট হাতাহাতি করে লাইটার খুঁজে পায় রাতুল। চিন্তিত ভঙ্গিতে টান দেয় আর ভাবে, এমন কপাল তার, বন্ধুর মুখটাও দেখা হলনা। ওখানে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা মোটেই নিরাপদ ছিলনা। কিন্তু এইবার কি হবে, এখন কি করবে ভাবতে ভাবতে মুখ শুকিয়ে যায় রাতুলের। এমন বিপদের মুখে সে কখনোই পড়েনি। সে তো আর সিনেমার হিরো না, থ্রিলারের নায়ক ও না। এত বড় একটা বিপদ সে একা কিভাবে সামাল দেবে? পুলিশ তো ঘনিষ্টতম বন্ধু হিসেবে তাকেই সন্দেহ করবে। ঘটনায় যদি ও ফেঁসে যায়, পড়ালেখা সব শেষ। বাড়িতে মা জানতে পারলে নির্ঘাত হার্ট এটাক করবে। কি হবে ওর তখন? সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে সে মেসের সামনে পৌঁছে যায়। ভাবছিল, ঠান্ডা মাথায় শাওয়ার নিয়ে পুরো ব্যাপারটা ভাববে। কিন্তু সেখানেও তার জন্য বিস্ময় অপেক্ষা করছিল।
ঘরের তালা খোলার সময় লক্ষ্য করল রাতুল, ঘরটা খোলা। কে এসেছে? দুর্ভাবনায় তার বুকের ভেতরটা ঢিপঢিপ করে। শত হলেও একটা সাদামাটা ছেলে সে, জীবনে কোন বিপদে জড়ায়নি। মুহূর্তের অবকাশে একরাশ দুশ্চিন্তা তাকে গ্রাস করে। ঘরে ঢুকতেই ২ জন পুলিশ দেখতে পায়। তার চেয়ে অবাক কথা, তাদের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল অহনা ! বাহ, ইলিশের তেল দিয়ে ইলিশ ভাজতে এসেছে। সুযোগ পেলে এই মেয়েকে সে ছেড়ে দেবে? কখনোই না।
“ আপনি রাতুল ? এত রাতে কোথা থেকে ফিরছেন? এই মেসে তো রাত ১১ টার পর বের হওয়া নিষেধ। এখন রাত ১ টা । এতক্ষণ কোথায় ছিলেন? ” উত্তরের অপেক্ষা না করে পুলিশ তাকে প্রশ্ন করে যায়।
“ জ্বি আমিই রাতুল। আসলে আমি রাত ১০:৩০ টার আগেই বের হয়েছিলাম একটা কাজে। ”
“ কোথায় গিয়েছিলেন জানতে পারি? ”
বলতে গিয়ে রাতুলের মুখে এবার কথা আটকে যায়। কিন্তু ওর এক্সপ্রেশন যদি আরো সন্দেহের জন্ম দেয় তাহলে মহা বিপদ। ভেবে চিন্তে ও জবাব দেয়, “ জ্বি আমার এক বন্ধুর বাসায়। কিছু জরুরি কাজ ছিল। ”
“ আর সেই বন্ধুর নাম নিশ্চয়ই সায়েম ? ”
রাতুলের আর বুঝতে বিন্দুমাত্র বাকি থাকেনা , আগুন যা লাগানোর মেয়েটা লাগিয়ে দিয়েছে। এখন মিথ্যা বলেও কাজ হবেনা। বরং এমন কিছু করতে হবে, যাতে এই ঘটনা থেকে যেকোনভাবে বেরিয়ে আসা যায়। নাহলে এই খুনী মেয়েকে কখনোই শিক্ষা দিতে পারবেনা সে। মুখে একদলা থুতু জমা হয় ঘৃণায়।
“ জ্বি রাইট। আ আআ আমি আমার বন্ধু সায়েমের বাসায় গিয়েছিলাম। ”
পুলিশ দু’জন একে অপরের দিকে তাকায়। যে এতক্ষন কথা বলছিল, তার এবার ভ্রু খানিকটা কুঁচকে যায়। সংবিত ফিরে পেয়ে উনি আবার মুখ খোলেন।
“ আপনাকে আমাদের সাথে একটু যেতে হবে এই মুহূর্তে। ”
বের হওয়ার আগে রাতুল অহনার দিকে একটা ক্ষুরধার দৃষ্টি হানে, সেই দৃষ্টিতে ঘৃণা বৈ কিছু ছিলনা।
একটা বরফ শীতল কক্ষে কতক্ষন একা একা বসে থাকা যায় বা থাকতে হয় এটা নিয়ে রাতুলের কোনো ধারনা নেই। কোনদিন কোনো কারণে তাকে পুলিশের হেফাজতে থাকতে হয়নি, আর রিমান্ডে যাওয়া তো পরের কথা। জীবনে সবকিছুই এখন নতুন মনে হচ্ছে। কারণ, যা যা হচ্ছে, তা তার জীবনে এই প্রথমবারের মত হচ্ছে। হঠাত জীবনে একটা বৈচিত্র্য খুঁজে পায় রাতুল। মনে মনে এসব আবোল-তাবোল ভাবতে ভাবতে তন্দ্রামত চলে আসে। হঠাত চেয়ার টানার কর্কশ আওয়াজে সে চোখ মেলে ধড়মড় করে বসে। হুম, যা ভেবেছিল তাই। এবার বোধহয়, ইনভেস্টিগেট করা শুরু হবে। নাহ, অহনাকে এই ঘটনায় জড়াবেনা সে। সুন্দর মত ব্যাপারটা এড়িয়ে যেতে যথাসাধ্য চেষ্টা সে করবে। মেয়েটার উচিৎ বিচার ওর হাতেই হওয়া উচিৎ।
“ আপনাকে হয়তোবা বেশিক্ষন সময় এখানে থাকতে হবেনা। কারণ, আপনার বন্ধু সায়েমের বাবা, আপনার ব্যাপারে জানতে পেরে আপনাকে ছাড়িয়ে নেয়ার সব বন্দোবস্ত করেছে। তার চেয়ে বড় কথা, তদন্তে আপনার বিরুদ্ধে কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ”
এতগুলো অঘটন ঘটে যাওয়ার পর এই দুটো সুখের সংবাদ রাতুলের কানে যেন মধুবর্ষণ করে। আর মনে মনে সায়েমের বাবাকে ধন্যবাদ না দিয়ে সে পারেনা। আর কিছু পারুক বা না পারুক , কিছু মানুষের কাছে ভাল পরিচয় রাখতে পেরেছে, যার সুবাদে এত বড় একটা বিপদ থেকে আজ সে বেঁচে গেছে। মনে মনে পরম করুনাময়ের কাছে হাজার শুকরিয়া জানায় রাতুল।
“ তবে, আপনাকে আমাদের কিছু তথ্য দিয়ে সাহায্য করতে হবে। কাল কি কি হয়েছিল, বা এর আগে সায়েমের সাথে আপনার কি কথা হয়েছিল, ও কোন বিশেষ কথা আপনাকে জানিয়েছিল কিনা, এই ব্যাপারগুলো আমাদের জানাবেন। হয়তোবা তথ্যগুলো ইনভেস্টিগেশনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। ”
রাতুল পুরো ব্যাপারটা যেভাবে হয়েছিল বর্ণনা করে। এমনকি, সে যে সায়েমের ঘর তল্লাশি করেছিল, এটাও স্বীকার করে। কিছু মিথ্যা লুকাতে হলে , কিছু সত্য বলতেই হয়।
“ রাতুল সাহেব, আমরা সেখানে আপনার ব্যতিত দ্বিতীয় কারো হাত বা পায়ের ফিঙ্গারপ্রিন্ট খুঁজে পাইনি। সঙ্গত কারনেই আপনার জুতার ছাপ পাওয়া গেছে। তবে আরো একটা পুরুষালি জুতার ছাপ পাওয়া গেছে ছাদে। ছাদের পিছন দিকটা থেকে সায়েমকে ফেলে দেয়া হয়েছিল। সম্ভবত, খুনী প্রচন্ড চাপে থাকায় সতর্কতা অবলম্বন করতে ভুলে গেছে কিংবা কোন ট্র্যাপ তৈরি করার জন্যই ইচ্ছাকৃতভাবে কাজটা করেছে। সেই জুতার সাইজ আর আপনার জুতার সাইজ ও সমান নয়। এটা প্রথম কথা। আর দ্বিতীয় কথা হল, রাত ১০:৩০ টা নাগাদ আপনি বের হলে , ১১:৩০ নাগাদ সায়েমের বাসায় পৌঁছে যাওয়ার কথা । তারপর খুন করা, ছাদে টেনে তোলা, নানা রকম ঝামেলা। আর আপনি গতকাল রাত ১০:৩০ টার আগে নিজের রুমেই ছিলেন, এটুকু আমরা নিশ্চিত হয়েছি। আর কোন কারণে সায়েমের বাসায় ছুটে গিয়েছিলেন, কি কি হয়েছে, এসব ও শুনলাম। ফরেনসিক রিপোর্টে পাওয়া গেছে, সায়েম খুব সম্ভব রাত ৮টার দিকে মারা গেছে। সো, আপাতত আপনি মুক্তি পাচ্ছেন। তবে সঙ্গত কারণেই আপনাকে হয়তো তদন্তের খাতিরে আবার আসতে হতে পারে এখানে। ”
পুলিশ ইন্সপেক্টর সোজাসুজি না বলে দিলেও রাতুল ভালভাবেই বুঝতে পারে, ওর উপর নজর রাখা হবে, সোজা বাংলায় ও এখন নজরবন্দী। যা করতে হবে খুব সাবধানে করতে হবে। নিজেকে আরেক দফা সতর্ক করে দেয় রাতুল। আর কথা বাড়ায় না। এই মুহূর্তে কথা বলার কোন শক্তি তার নেই। শোনার ও ইচ্ছে নেই। ঘুমে দু’চোখ ভেঙ্গে আসছে। পুলিশ ইন্সপেক্টরের আরেকটা কথায় তার সংবিত ফিরে আসে।
“ আরেকটা কথা আপনাকে জানানোর ছিল। আপনি কি জানেন আপনার বন্ধু কিভাবে মারা গেছে? ”
“ আপনিই তো বললেন, ছাদ থেকে ফেলে দেয়া হয়েছে। ”
“ হ্যা তা ঠিক। তবে তাকে বেশ পৈশাচিক ভাবে মারা হয়েছে। চোখের কোটর থেকে চোখদুটো তুলে নিয়ে ড্রিল মেশিনে ড্রিল করে মেরেছে কেউ। তবে চোখ দুটো খুঁজে পাওয়া যায়নি। ”
রাতুলের আচমকা বমি এসে যায়। মুখ ভর্তি বমি করে ওখানেই নেতিয়ে পড়ে সে। ওর বিশ্বাস হতে চায়না, একটা মেয়ে কিভাবে এত পৈশাচিক হতে পারে। ও না সায়েম কে ভালোবাসতো ? আর তার উপর পুলিশ বলছে, যে খুন করেছে, তার জুতার ছাপ পাওয়া গেছে। কোনো পুরুষ হয়তো সেই হত্যাকারী। ও সায়েমের সবচেয়ে কাছের বন্ধু। কই, কোন শত্রু আছে বলে তো ওর জানা নেই। ঘটনা ক্রমশ ঘোলাটে থেকে ঘোলাটে মনে হয় রাতুলের, খুব ঘোলাটে।
দরজা লক করে ঘাড় ফেরাতেই চট করে পুরো ঘরে একটা অসংগতি টের পায় অহনা। কেমন একটা পরিচিত গন্ধ, পুরুষালী শরীরের ঘ্রান। সায়েমের নাকি ! কিন্তু এটা কিভাবে সম্ভব? সায়েম যে মারা গেছে, এটা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। অনেকদিনের অভ্যাস তো, তাই ভ্রান্তি হতেই পারে। নিজেই নিজের প্রশ্নের জবাব দেয় অহনা। ব্যাগটা সোফার একপাশে ফেলে রেখে রুমের দিকে আগায় ও। রুমে ঢুকতে না ঢুকতেই ভূত দেখার মত চমকে ওঠে সে। তবে সামলে নেয় খুব তাড়াতাড়ি।
“ একটা খুনী আমার ঘরে কিভাবে আর কি করছে?” অহনা মুখে কপট বিরক্তি আর রাগ নিয়ে প্রশ্ন করে।
বাহ, মেয়েটার নার্ভ বলতে একটা জিনিস আছে বলতে হবে। নিজে খুন করেছে, তার উপর এত কনফিডেন্স নিয়ে কথা বলার জন্যও ইস্পাতের নার্ভ দরকার পড়ে। যাই হোক, এখানে ও অহনার সাথে সায়েমের রিলেশন নিয়ে পুরোনো কাসুন্দি ঘাঁটাঘাঁটি করতে আসেনি। ও খুব ভালো করেই জানে, মেয়েটা সায়েমের খুনের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত। বন্ধুত্ব জিনিসটাও এত ফেলনা হয়ে যায়নি যে ওর খুন কে করেছে এটা জানার পরও ওর বন্ধু হয়ে রাতুল চুপচাপ রুমে ঝিম ধরে পড়ে থাকবে। সায়েমের হাসি হাসি মুখটা মনে করে মনটা আরেক দফায় আদ্র হয়ে উঠতে চায়। না, এখন ইমোশনকে প্রশ্রয় দিলে নির্ঘাত মাঠে মারা যেতে হবে।
“ সবাই কি জানে জানি না, তবে আমি এটা ভালভাবেই জানি, সায়েমের খুনের পেছনে তুমি দায়ী। সেটা প্রত্যক্ষভাবে হোক বা পরোক্ষভাবেই হোক। তোমার যদি ধারনা হয়ে থাকে, আমি কিছুই জানিনা, সেটা ভুল ধারনা তোমার। ”
“ ওহ আসলেই স্যরি। আমার ওকে শেষ করার আগে তোমাকে শেষ করা উচিত ছিল। আমারই বোঝা উচিত ছিল, সায়েম হয়তো বিপদ টের পেয়ে তোমাকেই সেটা আগে জানাবে। সেক্ষেত্রে তোমাকে সরিয়ে দিলেই আর সমস্যা থাকতো না। বাট সেটা আমি করিনি বলে এখন নিজের উপর নিজেরই ক্ষোভ হচ্ছে।” দাঁত- মুখ খিঁচিয়ে জবাব দেয় অহনা।
রাতুল এবার ফ্যাকাশে ঠোঁটে খানিকটা হাসে।
“ দেখ, পুলিশের ইনভেস্টিগেশনে একসময় না একসময় তুমি ধরা পড়বেই। সো, তোমার জন্য ভাল এটাই হবে, তুমি নিজেই স্বীকার কর। এতে শাস্তি মওকুফের একটা সুযোগ পাবে তুমি। আর তুমি জানোনা, তোমার বোনের মৃত্যুর পেছনে সায়েমের হাত নেই। যার হাত ছিল, তাকে শাস্তি না দিয়ে তুমি সায়েমের উপর যে অত্যাচার করেছ, সেটার জন্য প্রশাসনের হাত থেকে তুমি বেঁচে গেলেও আমার হাত থেকে বেঁচে যাবে, এটা ভাবা ভুল হচ্ছে তোমার। ”
“ ওহ রিয়েলি? তুমি এত ডেয়ারিং এটা তো আগে আমার জানা ছিলনা। আর তুমি কিভাবে ভাবলে, সায়েমের মার্ডারের সাথে আমি সরাসরি সম্পৃক্ত থাকবো? হয়তো প্রফেশনাল কোনো কিলারকে দিয়েই আমি কাজটা করিয়েছি। এন্ড ইউ নো ওয়েল, প্রফেশনালরা কোন প্রকার খুঁত রেখে কাজ করেনা। ” অহনার চোখে মুখে একটা পৈশাচিক হাসি ফুটে ওঠে।
বন্ধুর মৃত্যুর সময়ের যন্ত্রনাটা রাতুল একটু হলেও বুঝতে পারে । বুকের ভেতরে কেমন একটা চাপ অনুভব করে । ভেতরের চাপা রাগটা আর সামলে রাখতে পারেনা।
“ ইউ বিচ ! ” গালি আওড়াতে আওড়াতে অহনার গালে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দেয়। মেয়েটাও কিছুক্ষণ বিদ্ধস্ত দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু বেশি সময় নেয়না। প্যান্টের পকেট থেকে একটা ছোট ছোরা বের করে রাতুলের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। আকস্মিক ধাক্কাটা রাতুল সামলাতে পারেনা। তাই ছোরাটা বিনা বাঁধায় ওর বাম হাতের পেশীতে গেঁথে যায় শক্তভাবে। মুহূর্তের মধ্যেই শরীরটা অবশ হয়ে আসতে চায়। ফিনকি দিয়ে রক্ত ছড়িয়ে পড়তে থাকে। এবার আর সুযোগ দেয়না রাতুল। কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে এক হাতে মেয়েটার চুলের গোছা ধরে টেনে ধরে অন্য হাতে বাম পাশে রাখা সিরামিকের ফুলদানিটা প্রবল বেগে আঘাত করে ওর মাথায়। মেয়েটা সাথে সাথে জ্ঞান হারায়। যাক, এই যাত্রা প্রাণে বেঁচে গেছে সে। কিন্তু একে এখানে রাখা যাবেনা। কোথাও গুম করে ফেলতে হবে। তারপর খুঁজে বের করতে হবে আসল খুনিটা কে। সেটাও এজ সুন এজ পসিবল!
সায়েমের খুনের পর পর অহনার গায়েব হয়ে যাওয়ায় সবার সন্দেহের তীর স্বাভাবিকভাবেই এখন অহনার উপর। পুলিশ দুটো ঘটনার সামঞ্জস্য খুঁজছে, হয়তোবা পেয়েও গেছে। কিন্তু রাতুলের কাজ এখনো শেষ হয়নি। ওকে খুঁজে বের করতেই হবে, আসল খুনি কে। কিন্তু কিভাবে? এত হাজার হাজার মানুষের ভিড়ে ও কিভাবে জানবে কে সেই ছেলে যাকে ভাড়া করে অহনা এই কাজটা করেছে? নাহ, কাজটা ততটা সহজ নয়। তবে, অহনার ল্যাপটপ ঘাঁটাঘাঁটি করে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ও পেয়েছিল, যেটা আপাত দৃষ্টিতে এখন আর কাজের না। তবে বলা যায়না, হয়তো এটাও গুরুত্বপূর্ণ কিছু হতে পারে। এসব ভাবতে ভাবতে উদাস মনে ক্যান্টিনের দিকে তাকিয়ে থাকে রাতুল। ওই তো , সেদিনের ওই মেয়েটাকে দেখা যাচ্ছে। আচ্ছা, মেয়েটার নাম জানা হলনা । জানতে পারলে মন্দ হতনা। ওর শরীরে একটা আলস্য ভর করে। নয়তো ও নিজেই উঠে গিয়ে মেয়েটার নাম জেনে আসতো হয়তোবা। মেয়েটার দিকে আবার তাকায় রাতুল। এদিকেই তো আসছে বলে মনে হচ্ছে। কি আজব !
মেয়েটা নীরবে সামনে এসে দাঁড়ায়। চোখে মুখে কৌতূহল। মেয়েটা এভাবে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে কেনো?
“ কিছু বলবেন? ”
মেয়েটা ডান থেকে বামে মাথা নাড়ে। তারপর একটু হাসে। রাতুলের বুকের ভেতরটা কেমন যেন মুচড়ে ওঠে। এত সুন্দর হাসি কেউ দিতে পারে? আচ্ছা , মেয়েটাকে তো ভালভাবে খেয়াল করা হয়নি। হুম, মেয়েটার চুলগুলো বেশ সিল্কি। একজোড়া জোড় ভ্রু, টানা টানা দুটা চোখ, আর ঠোঁটের কাছে একটা তিল।
বাহ। এই সব কিছুই কি সৌন্দর্য, এগুলোকেই বাংলায় বিশেষণ বলে?
মেয়েটা এবার খানিকটা ভ্রু নাচায় প্রশ্নের ভঙ্গিতে। রাতুল এবার লজ্জা পায়। এভাবে কোন মেয়ের দিকে ডেবডেব করে তাকিয়ে থাকা অসভ্যতা। কি করবে বুঝতে পারেনা রাতুল। মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে। বসার জায়গা করে দেবে? দেয়া যায়। তাই, একটু পাশে সরে মেয়েটাকে বসার জায়গা করে দেয় ও। কিন্তু কি বলবে ভেবে পায়না। একটা মেয়ের সাথে কি বলতে হয়, এটাও সে জানেনা। তার উপর, মেয়েটা কেনো এসেছে, কেনোই বা চুপচাপ বসে আছে, কিছুই বুঝতে পারেনা রাতুল। শেষমেশ জিজ্ঞেস করে, “ ভাল আছেন তো? ”
কথাটা জিজ্ঞেস করে নিজের কাছেই নিজেকে বোকা মনে হয় রাতুলের। ফর্মাল প্রশ্নটাও কেমন যেন মাইন্ড করে গেছে আর বিদ্রুপ করে বলছে, “শালা , এই প্রশ্ন করার আর মানুষ পেলিনা ! ” যাক, মেয়েটা একটু হেসে মাথা নাড়ে। হু, সে ভাল আছে। ভাল থাকাই ভাল। জগতে ভাল থাকাটা খুব কষ্টসাধ্য।
এমন সময় কয়েকটা ছেলে মেয়ে এগিয়ে আসে । এই মেয়েটার ব্যাচমেট হবে হয়তো। মেয়েটা উঠে দাঁড়ায়। রাতুলের মনে হয় মেয়েটা ওকে কিছু বলতে চাচ্ছে। হয়তো লজ্জ্বার বশে বলতে পারছেনা, নয়তো কোনো একটা কাজ করে দেয়ার কথা ভাবছিলো, কিন্তু এখন হয়তো ভাবছে কাজটা রাতুলকে দিয়ে হবেনা, বা এমন অনেক কিছুই হতে পারে যা রাতুলের চিন্তার বাইরে । এই মুহূর্তে কোন কিছুই পরিষ্কার না। রাতুল গলা খাঁকড়ি দিয়ে জিজ্ঞাসা করে, “ কিছু বলবেন? ” মেয়েটা উপর থেকে নিচে মাথা নাড়ায়। রাতুলের এবার মেজাজ চড়ে যায়। এটা কি আদিখ্যেতা ! কথা বলেনা, পুতুলের মত মাথা নাড়ে শুধু। বাংলাদেশে কি কথা বলার উপর ট্যাক্স চালু হয়েছে নাকি ? কই , রাতুল তো শোনেনি। এমন সময় পাশ থেকে একটা মেয়ে বলে ওঠে, “ অরিন তো কথা বলতে পারেনা। ও বাক প্রতিবন্ধী। ” কথাটা শুনে মনের কোনো একটা গোপনে যেন একটা ছোটখাট দুর্যোগ হয়ে যায়। মেয়েটার মুখের দিকে তাকাতে আর সাহস হয়না। যদি তাকিয়ে দেখি বড় বড় চোখে শান্ত দিঘীর মত পানি টলমল করছে? কষ্ট হবে হয়তো। রাতুল আর তাকায় না। পিছনে ফিরে হাঁটতে শুরু করে। পেছনে তাকালে হয়তো দেখতে পেতো, মেয়েটার চোখে শান্ত দিঘীর জল উপচে পড়ছে।
পরদিন কলেজে এসে রাতুল কড়ই গাছটার নিচে হেলান দিয়ে বসে থাকে আর ভাবে, কালকের মত যদি আজও মেয়েটা হঠাত করে হাজির হয়ে যেত, ভালই লাগতো হয়তো রাতুলের। হঠাত চেঁচামেচির শব্দে রাতুলের ধ্যান ভাঙ্গে। এদিক ওদিক ইতিউতি তাকিয়ে রাতুল ঘটনা বুঝতে পারে। পলিটিক্যাল ক্ল্যাশ। এই মুহূর্তে এখানে থাকার কোন মানেই হয়না। পরিস্থিতি খারাপ হলে যে গোলাগুলিও হতে পারে, এটা এই কয়েক বছরে ওর ভাল বোঝা হয়ে গেছে। ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে এবার গতি দ্রুত করে রাতুল। হঠাত অরিন মেয়েটাকে ওর চোখে পড়ে। শিট ! মেয়েটা ওদের ভিড়ে আটকে গেছে। ওদিকে অলরেডি মারামারি শুরু হয়ে গেছে। রাতুল এক মুহূর্ত চিন্তা করে, মেয়েটাকে কি ওখান থেকে নিয়ে আসবে? চিন্তা শেষ হওয়ার আগেই রাতুল আবিষ্কার করে, ও দৌড়াচ্ছে। কি আশ্চর্য ! মেয়েটাকে কোনভাবে দুই হাতে আগলে ভিড় থেকে বের করে আনে রাতুল। রাস্তায় এসে দ্রুত একটা ট্যাক্সি থামিয়ে দুইজন উঠে পড়ে। মেয়েটাকে ওর বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে রাতুল মেসে ফিরে যাবে। এতক্ষন দুজনই চুপচাপ। এবার রাতুল নিজেই কথা বলে, “ আপনাকে কোথায় নামিয়ে দেবো? ” মেয়েটা একটা আহত দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকে। রাতুলের সহসা মনে পড়ে যায়, বেচারী তো কথা বলতে পারেনা। রাতুলের মধ্যে কেন যেন একটা কষ্ট কাজ করে। চিন্তা না বাড়িয়ে ও অরিনের দিকে একটা খাতা আর কলম এগিয়ে দেয়।
“ কষ্ট করে এখানে আপনার ঠিকানাটা লিখে দিন। আমি পৌঁছে দিচ্ছি। ”
মেয়েটা কাঁপা কাঁপা হাতে ঠিকানা লিখে দেয়। আর রাতুল একমনে মেয়েটার হাত আর মুক্তোদানার মত হাতের লেখার দিকে তাকিয়ে থাকে। এত ভাল লাগা কাজ করা কি ঠিক? রাতুল জানেনা, আসলেই জানেনা।
এরপর থেকে কলেজে আসলেই রাতুল অরিনকে খুঁজে বেড়ায়। দেখা হলে টুকটাক ভাব বিনিময় হয়, ঘোরাঘুরি ও। জীবনটা হঠাত করেই যেন অন্যরকম লাগে রাতুলের কাছে। যেন ও ভুলে যেতে চায়, মাত্র কয়েকটা মাস আগেই জীবনে কত বড় একটা দুর্যোগ হয়ে গেছে, কতটা এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল জীবনটা। মেয়েটা এসে যেন নিজের হাতে সব গুছিয়ে দিচ্ছে এক মায়াবতী পরির মত। হ্যাঁ, রাতুল বোধহয় ভালবেসে ফেলেছে মেয়েটাকে।
অরিন কথা বলতে পারেনা, এই দুঃখটা অরিন মনের গভীরে অনেক সযত্নে পুষে রেখেছে এটা রাতুল বোঝে। কিন্তু তাই বলে কখনো ভালবাসা কম হয়ে যায়নি ওদের। কথা বলতে পারেনা তাতে কি? ভাল তো বাসতে পারে নিশ্চয়ই। যদিও তেমন কোন কথা ওদের মাঝে এখনো হয়নি। হয়তো দুই পক্ষই দুই পক্ষের স্বীকারোক্তির আশায় বসে আছে। মাঝে মধ্যে রাতুলের ভয়ই করে, সায়েমের মত অরিনকেও হারিয়ে ফেলবে না তো? ধুর, উদ্ভট এসব কথাবার্তা ভেবে নিজের উপর খুব রাগ হয় রাতুলের। মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরার সাহস ওর কখনোই হয়না, কিন্তু ওর চোখের দিকে তাকিয়ে একটা ভরসা খুঁজে নেয় রাতুল, যেন বলছে, “ আমি কোথাও হারাবোনা। ”
দৈনন্দিন কাজের ফাঁকে ফাঁকে শত ব্যস্ততার মাঝেও একটা কাজ করতে রাতুল ভোলেনা। প্রতিদিন কলেজে আসার আগে, ঐ অহনাকে একবার দেখে আসে। অহনাকে রাখার জন্য একটা ফ্ল্যাট ওর ভাড়া নিতে হয়েছে। কেউ জানেনা এখানে রাতুল ছাড়াও আরো একজন থাকে। জানার কথাও না। একটা ফ্লেক্সিকাফ দিয়ে অহনার হাত দুটো বাঁধা থাকে। চাইলেও কিছু করতে পারবেনা। প্রতিদিন নাস্তা খাইয়ে কড়া ডোজের একটা স্লিপিং ইঞ্জেকশন পুশ করে রাতুল কলেজে চলে আসে। এই ঘুম রাতের আগে ভাঙ্গার সম্ভাবনা শুন্যের কাছাকাছি। তবে আসার আগে প্রতিদিনকার জেরা অব্যাহত থাকে। কে সেই হত্যাকারী, কে সায়েমকে খুন করেছে। নাহ, জবাব আসেনা। মেয়েটা আসলেই একটা হারামী !
কলেজে পৌঁছেই রাতুলের প্রথম কাজ অরিন মেয়েটাকে খুঁজে বের করা। ওদের ডিপার্টমেন্টের সামনে কিছুক্ষন পায়চারি করে রাতুল। না, অরিনের দেখা নেই। ওর কয়েকটা বন্ধু বান্ধবকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারে, অরিন আজ কলেজে আসেনি। মেয়েটার তো কোন ফোন নাম্বার ওর কাছে নেই, তবে বাসার ঠিকানা আছে। যাবে নাকি? ব্যাপারটা খুব বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যায়না? কিছুক্ষন ভেবে নেয় রাতুল। তারপর শার্ট ঠিক করে হাঁটা ধরে লম্বা লম্বা পা ফেলে। হ্যাঁ, ও যাবে অরিনের বাসায়। মেয়েটা কি ওকে দেখে অবাক হবে খুব ? হলে হোক। মেয়েটা কিভাবে বুঝবে ওকে একদিন না দেখলে রাতুলের কেমন কষ্ট হয় !
অরিনদের বাসাটা নিজেদের। তাই দেখলেই বোঝা যায় আলিশান টাইপের বড়লোক ওরা। ঘরের কার্পেট, দেয়ালে পেইন্টিং সবখানে ঐশ্বর্যের পরিচয়। হুম, কিন্তু মেয়েটা খুব সাদামাটা। একদম যেন মাটির পরী ! অরিনের ঘরটা কোনদিকে কে জানে। একজন মেইড অবশ্য উপরে অরিনকে ডাকতে গেছে। এখনো আসছেনা। ও কি যাবে উপরে? এটা কি বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যায়না? তবুও এখানে চুপচাপ বসে থাকার চেয়ে উপরে যাওয়া ওর কাছে বেটার মনে হয়। তাছাড়া উপরে একটা বড় ব্যালকনি আছে বলে মনে হচ্ছে। ওখানেই না হয় দাঁড়িয়ে থাকা যাবে। নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভাল, ভাবতে ভাবতে দোতলার সিঁড়ি ভাংতে শুরু করে রাতুল। মেইডটাকে দেখা গেলো এইবার দোতলায় উঠতেই।
“ আপনে একটা কাম করেন, আফার রুমে যাই বইথাকেন। আফা গুসোল করতাসেন। ”
রাতুল মৃদু মাথা নেড়ে ঢুকে পড়ে। বাহ, এত বড় রুম ! একপাশে বইয়ের সেলফ, কি নেই সেখানে। সব ধরনের বই থরে থরে সাজানো। একটা রিডিং টেবিল রাখা, তাতে একটা ল্যাম্প ও। বোঝাই যাচ্ছে, পাগলীটার রাত জেগে বই পড়ার অভ্যাস আছে। অন্যপাশে ওর বেড, ড্রেসিং টেবিল, টিভি সবই আছে দেখা যায়। এই রুমের সাথে আরেকটা রুম দেখা যাচ্ছে। দরজাটা খোলাই মনে হয়। ওদিকটায় কি? একবার বাথরুমের দরজার দিকে তাকায় রাতুল। এখনো জল পড়ার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে । মেয়েটা এখনো গোসল করছে। যাওয়া যায় তাহলে এদিকটায়। সুন্দর কোন বারান্দা হবে হয়তো মেয়েটার একাকী সময় কাটানোর জন্য।
ধুলোবালি ভরা রুমে ঢুকে বারকয়েক হাঁচি দেয় রাতুল। শিট ! পুরো বাসা এত ঝকঝকে আর এখানটা এত নোংরা ? বোধ হয়, স্টোর রুম। ধুর হোক ছাই, এখানে ঢুঁ মারাই উচিৎ হয়নি। বের হয়ে যাবে, এমন সময় একটা কাঁচের জারের দিকে রাতুলের চোখ যায়। ঠিক বোঝা যাচ্ছেনা, মনে হচ্ছে কিছু একটা সংরক্ষন করে রাখা হয়েছে জারে। স্টোর রুমটাও বায়োলজি ল্যাব বানিয়ে রেখে দিয়েছে দেখছি মেয়েটা। একটু একটু করে এগিয়ে যায় রাতুল। প্রথমে বুঝতে পারেনা, জিনিসটা আসলে কি। কাঁচের জারটা হাতে তুলে নেয় আলগোছে। ইয়া আল্লাহ ! মানুষের হাতের আঙ্গুল ! এগুলো এখানে আসলো কিভাবে? আরেকটা জারের দিকে ওর নজর পড়ে। মানুষের চোখ! রাতুলের গা রিরি করে ওঠে।
দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে আগের মত রুমে যেয়ে বসে পড়ে রাতুল। ওর গা কাঁপতে থাকে। মনে হয় ঘুরে পড়ে যাবে। কিন্তু না, এখন ওকে যেভাবেই হোক, মেয়েটার ডায়েরী খুঁজে বের করতে হবে। রাতুল সিউর, মেয়েটা যেহেতু কথা বলতে পারেনা, ওর সব কাহিনী একটা ডায়েরীতেই থাকার কথা। এটা অবশ্য ওর ইন্ট্যুশন ছাড়া কিছু না। রিডিং টেবিলের ড্রয়ারে, বেডের সাথের আলমারিতে, বইয়ের ফাঁকে কোথাও পায়না এমন কিছু। হতাশ লাগছিলো রাতুলের কাছে। এমন সময় মেয়েটার সেলফে কিছু মেডিকেলের বইপত্র দেখে। ব্যাপার কি? মেডিকেলের বইপত্র ওর লাগবে কেন? বইগুলোও বেশ নতুন, তবে কিছু পুরানোও আছে। বইগুলো হাতে নিয়ে দেখতে থাকে রাতুল। এমন সময় হলুদ মলাটের একটা প্যাড দেখতে পায়। এটা কি? একবার মেলে ধরে। ইয়েস ! এখানে হয়তো কিছু লিখে রেখেছে। বাথরুমের দরজা খোলার আওয়াজ পেতেই রাতুল এক দৌড়ে বসার ঘরে চলে যায়। এখানে আর বেশিক্ষন থাকা যাবেনা। অরিনের সাথে সৌজন্যমূলক কথাবার্তা বলেই বিদায় নিতে হবে।
ডায়েরীর অর্ধেক পড়ে মোটামুটি অবাক হল রাতুল। মেয়েটা পুরোদস্তুর সাইকো। তার চেয়ে বড় কথা , ও সিরিয়াল কিলার। ওর বাবা পেশাদার ডাক্তার। বাবা ডাক্তার হওয়ার কারনে, মেডিকেলের বইপত্র ওর রুমে ঠাসা। ব্যবচ্ছেদ থেকে শুরু করে সবকিছু ওর নখদর্পণে। কিন্তু ওর বাকশক্তি নেই বলে, মেডিকেলে পড়ার ভাগ্য হয়নি। শুধু যে এটাই কারন তা না। ও শারীরিকভাবেও বেশ দুর্বল। এই মায়াবতী মেয়েটাকে দেখে কে বলবে, এই মেয়েটা এত ভয়ংকর। ডায়েরী পড়ে বিতৃষ্ণা চলে আসলো রাতুলের। এক চুমুক পানি খেয়ে স্টোর রুমে একবার উঁকি দেয় রাতুল। মরে গেছে নাকি শালী ? কে জানে।
খাটে হেলান দিয়ে ডায়েরীর বাকি অংশটুকু পড়তে বসে রাতুল। কিভাবে পৈশাচিক ভাবে একের পর এক হত্যা চালিয়ে গেছে, তার সূক্ষ্মাতিসূক্ষ
রকেটের গতিতে রাতুল ডায়েরীটা খুলে আবার পড়তে থাকে। অহনার সাথে অরিনের পরিচয়, অহনার ওকে কনভিন্স করা, সায়েমকে খুনের প্ল্যানিং করা, খুন করা, অহনা মিসিং হওয়ার পর ওকে খোঁজা, রাতুলের সাথে পরিচয়, অহনাকে কিডন্যাপ করার পেছনে ওকে সন্দেহ করা, এট লাস্ট ওকেও খুন করার প্ল্যানিং, সমস্তটাই খুব সুন্দরভাবে লেখা আছে। শেষ লেখাটা ২ মাস আগের। এতক্ষনে মেয়েটা বোধহয় ডায়েরী মিসিং, এটা টের পেয়ে গেছে। আর বুঝেও গেছে কাজটা কার। রাতুলের এখন কি করা উচিৎ? ডায়েরীতে কিভাবে খুন করবে সেরকম তো কিছু লেখা নেই। নয়তো ব্যবস্থা নেয়া যেত হয়তো সেভাবে। এতদিন যাকে হন্যে হয়ে খুঁজেছে, অবশেষে তাকে খুঁজে পেয়েছে, তাও এমন একজন, যা সে কল্পনায়ও ভাবতে পারেনি। এই মেয়েটাকে খুন করা তার পক্ষে কতখানি অসম্ভব, এটা রাতুল ভাবতেও পারেনা। মাথায় মনে হয় ট্রাফিক জ্যাম লেগে যায়। এই ডায়েরীটা পুলিশের হাতে পড়লে অরিনের ফাঁসিও হয়ে যেতে পারে। কোন পদক্ষেপ না নিলে, অরিনের হাতে রাতুল মারা পড়বে ছারপোকার মত। কোন উপায় দেখেনা রাতুল। এমন সময় দরজায় কলিংবেল পড়ে। রাতুলের বুক ধুকধুক করতে থাকে। এবার কি করবে সে?
দরজা খুলে অরিনের মুখটা দেখে রাতুলের অবাক হওয়াটা বিপদসীমা পেরিয়ে যাওয়ার কথা, কারন রাতুলের বাসার এড্রেস মেয়েটার জানার কথা না। কিন্তু রাতুল জানতো অরিন আসবেই। এটা সিক্সথ সেন্স হোক বা সেভেন্থ সেন্সই হোক। রাতুল মুখে একটা কৃত্তিম বিস্ময় ফুটিয়ে তোলার বৃথা চেষ্টা করে ।
“ আরে তুমি? এত রাতে কিভাবে এলে? ”
কথার জবাব না দিয়ে অরিন সোজা ভিতরে ঢুকে পড়ে। এক মুহূর্তের জন্য রাতুলের মনে হয়, ও মরে গেলেও এই মেয়েটার গায়ে একটা আঁচড়ও দিতে পারবেনা। মেয়েটার মন চাইলে ওকে শত টুকরা করে গ্লাস জারে ভরে রেখে দিক, ও অবলীলায় বুক পেতে দেবে আজ।
অরিন এবার স্টোর রুমের দিকে হাঁটা ধরে। রাতুল খপ করে ওর হাত ধরে ফেলে।
“ ওদিকে কোথায় যাচ্ছ? ”
অরিন চোখে মুখে একটা বিরক্তির ভাব ফুটিয়ে তোলে। রাতুলের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে স্টোর রুমে ঢুকে পড়ে। খানিক পরে লাশটা টানতে টানতে বের করে আনে। অহনার লাশ! ঘাড়টা একপাশে কাত করা, নির্ঘাত ঘাড়টা খুব খারাপভাবে মচকে গেছে। মুখের একপাশ দিয়ে রক্ত গড়িয়েছিল বোধহয়, এখন শুকিয়ে গেছে। মেয়েটা মরলো কিভাবে? রাতুলের হাত পা জমতে শুরু করে। অহনা নির্ঘাত অরিনের হাতেই মারা গেছে। অরিন আগেও এই বাসায় এসেছে? হতে পারে। চাবি পেলো কই, এই তুচ্ছ ভাবনা রাতুল ভাবেনা। ও নিজেও জানে এটা কোনো ম্যাটার না। অরিন আজ কলেজে যায়নি কেনো এই চিন্তা এবার রাতুলের কাছে পরিষ্কার হয়। রাতুলের ঠিকানা কিভাবে পেয়েছে মেয়েটা এটাও ওর কাছে ক্লিয়ার হয় এবার। সেদিন ট্যাক্সি করে ওকে ফিরিয়ে দেবার পর একই ট্যাক্সি করে.........উফফ
অরিন দক্ষ হাতে একটা বড় প্যাকেটে লাশটা ঢুকাতে থাকে। রাতুল কিছুই বলতে পারেনা। মনে হয় সব কথা জমে গেছে। এত বড় ধাক্কা খাওয়ার জন্য আল্লাহ ওকে এতদিন না বাঁচিয়ে রাখলেই পারতো। মুখ স্বাভাবিক রাখলেও মনে মনে মুষড়ে পড়ে রাতুল। হয়তো খানিক বাদে ওকেও ঠিক এভাবেই লাশ হয়ে থাকতে হবে। ওর পরিচয় আর রাতুল থাকবেনা। ওর পরিচয় হবে লাশ, শুধুই লাশ !
এভাবে কতকাল কেটে যায় রাতুল জানেনা। ও ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে দেয়ালে হেলান দিয়ে। চেয়ারে বসে অরিন একমনে অহনার লাশের দিকে মুখ বিকৃত করে তাকিয়ে আছে। একটু আগেই রাতুল অহনার বোনের মৃত্যুর ঘটনাটা বিস্তারিতভাবে বলেছে। অরিনের চোখে প্রথমবারের মত রাতুল বিস্ময় দেখে। এভাবে অনেকটা সময় দাঁড়িয়ে থাকার পর রাতুল এবার একটু নড়েচড়ে দাঁড়ায়। অরিনের কাছে ওর কিছু জানবার আছে।
“ আমি কি জানতে পারি, তোমার বান্ধবীকে তুমি খুন করলে কেনো? ”
স্বাভাবিকভাবেই ওপাশ থেকে কোন জবাব আসেনা। রাতুল মাথা নিচু করে অপরাধীর মত দাঁড়িয়ে থাকে। অরিন কিছুক্ষন পর উঠে আসে। এক হাতে একটা ছোট কাগজ। রাতুল ধীরে ধীরে কাগজের ভাঁজটা খুলে পড়তে শুরু করে। লেখার সারসংক্ষেপ এটাই, রাতুলকে ফলো করতে করতে ও বাসা চিনে যায়। আজ সকালে যখন রাতুলের বাসায় আসে, তখন স্টোর রুমের চাবি না পেয়ে বইপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করে, যেখানে কিছু পত্রিকা আর রাতুলের ব্যক্তিগত ডায়েরী ছিল। তাতে লেখা ছিল, অহনার বোনের মৃত্যুতে সায়েমের হাত ছিলোনা, ইভেন সায়েমের সাথে রাতুলের সব কথাবারতাও। স্টোর রুমের চাবি না পেয়ে বাধ্য হয়ে তালাটা ভাংতে বাধ্য হয় অরিন। সেখানে খুঁজে পায় অহনাকে। কিন্তু অহনাকে ছাড়িয়ে নিয়ে মুক্ত করে পুরো ঘটনা বলার পরও ও রাতুলকে মারার প্ল্যান করতে থাকে। অরিন মুহূর্তের মধ্যে ওর ভুলটা ধরতে পারে। গলায় প্যাচানো ওড়নাটা দিয়েই একবার শক্ত করে বাঁধন দেয় অহনার গলায়। তারপর মৃত্যু নিশ্চিত করতে ওর ঘাড়টা মচকে ফেলে। দেরী হয়ে যাচ্ছে বুঝতে পেরে ওকে ওই অবস্থায় রেখেই দরজায় তালা ঝুলিয়ে বাসায় ফিরে আসে। এসব কিছু রাতুলের জানার কথা ছিলনা। রাতুল এই মাত্র সব জানতে পারলো। মেয়েটা কি তাহলে তার ভুল বুঝতে পেরেছে? আসলেই পেরেছে? অরিন হাতে একটা নাইফ নিয়ে হঠাত উঠে আসে চেয়ার থেকে। রাতুল এতক্ষন মাটির দিকে তাকিয়ে ছিল। এবার একবার মুখ তুলে তাকায় রাতুল কিছুক্ষনের জন্য। তারপর আবার আগের মত মাটির দিকে তাকিয়ে থাকে, মাটিতে পা দিয়ে আঁকিবুঁকি করে। ওর হয়তো আজ মরার ভয় নেই, তাই এক অবাক করা নিঃস্পৃহতা ওকে ঘিরে ধরে। নিজের নিঃস্পৃহতায় ও নিজেই অবাক হয়। ও খুব বড় অপরাধী কি? অনেক বড় অপরাধী , যারা জানে তাদের অন্যায় ক্ষমার অযোগ্য, তারাও বাঁচার সুযোগ পেলে কাজে লাগায়। আর রাতুল? ও জানে, ওকে বাঁচতে হলে অরিনের ক্ষতি করে ওকে বাঁচতে হবে। এর থেকে মরে যাওয়া ভালো বোধহয়। অরিন নাইফটা রাতুলের গলায় ঠেকিয়ে ধরে। রাতুল শেষবারের মত বুক ভরে নিঃশ্বাস নেয়। হয়তো এই নিঃশ্বাস তার শেষ নিঃশ্বাস। চোখ দুটো বন্ধ করে ফেলে স্বাভাবিকভাবেই।
শুধুই গল্প থেকে নেয়া
0 টি মন্তব্য:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন